বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০১ পূর্বাহ্ন

ঘোষনা :
  সম্পূর্ণ আইন বিষয়ক  দেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা   দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল এর  পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা   । 
সংবাদ শিরোনাম :
ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাবে যা করণীয় জমি আপনার, দখল অন্যের! কী করবেন? রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে সংবিধান, আইনী নৈরাজ্য ও অতীত ইতিহাস! শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতির মিথ্যাচার বনাম সাংবিধানিক সমাধান! সহায় সম্পত্তি পুণ্যের কাজে ওয়াক্ফ গঠন ও প্রাসঙ্গিকতা! শেকড়ের সন্ধানে সাঁইজির ধামেঃ লালন কি জাত সংসারে— রক্তাক্ত মাহমুদুর রহমানের কুষ্টিয়ায় আগমন বনাম দুধের মাছিদের আনাগোনা! জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কতটা সংবিধান ও আইনসম্মত! ক্রেতা ঠকে গেলে বিক্রেতার বিরুদ্ধে যত আইনগত প্রতিকার! আইনে জামিন চর্চা বনাম বিচারকের পদত্যাগের দাবীতে আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ!
তালাকের পর স্ত্রীর মামলায় আপনি খালাস পেতে পারেন

তালাকের পর স্ত্রীর মামলায় আপনি খালাস পেতে পারেন

 

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
স্বামীর সাথে দাম্পত্য কলহ হলেই স্ত্রীরা স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে যৌতুক মামলা করে থাকে। এ মামলাটি হয়ে থাকে ২০১৮ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ৩ ধারায়। এখানে বলা হয়েছে, যদি বিবাহের কোনো এক পক্ষ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, বিবাহের অন্য কোনো পক্ষের নিকট কোনো যৌতুক দাবি করেন, সেটা হবে এ আইনের অধীন একটি অপরাধ এবং সেজন্য তিনি অনধিক ৫ (পাঁচ) বৎসর কিন্তু ন্যূনতম ১ (এক) বৎসর কারাদ- বা অনধিক ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা অর্থদ- অথবা উভয় দ-ে দ-নীয় হইবেন। আরেকটি মামলা করে থাকেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ১১(গ) ধারায়। এখানে বলা হয়েছে, যদি কোন নারীর স্বামী অথবা স্বামীর পিতা, মাতা, অভিভাবক, আত্মীয় বা স্বামীর পক্ষে অন্য কোন ব্যক্তি যৌতুকের জন্য উক্ত নারীর সাধারণ জখম করে তাহলে তিনি বা তারা তিন বৎসর কিন্তু ন্যূনতম এক বৎসর সশ্রম কারাদ-ে দ-নীয় হইবেন এবং উক্ত দ-ের অতিরিক্ত অর্থদ-েও দ-নীয় হইবেন। উপরোক্ত দুটি ধারার মামলার সংজ্ঞা থেকে আমরা সহজেই পাই যে, এ মামলা করতে হলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক থাকতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় যে, দাম্পত্য কলহে স্ত্রী বাবার বাড়িতে চলে গেছে। স্বামী বার বার আনতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। এরপর স্বামী তালাক দিয়েছে। স্ত্রী তালাকের নোটিশ প্রাপ্তির পর থানা কিংবা আদালতে গিয়ে মিথ্যা যৌতুকের মামলা করেছে। এক্ষেত্রে আসামী গ্রেফতার হলে কিংবা সমন প্রাপ্তির পর আসামীপক্ষ বিজ্ঞ আদালতে নিবেদন করেন যে, বাদিনী তালাকের নোটিশ প্রাপ্তির পর এতো দিন পর আসামীর প্রতি রাগান্বিত ও প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে হয়রানীমূলক মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন। এ বক্তব্যের সমর্থনে বিজ্ঞ আদালতের সামনে ফিরিস্তি আকারে তালাক প্রদানের নোটিশ, ডাক রশিদ, প্রাপ্তি স্বীকারসহ উপযুক্ত প্রমান পেশ করে থাকেন। মাননীয় আদালত সার্বিক দিক বিবেচনা করে এবং তালাকের পর মামলা সম্পর্কিত উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে আসামীকে জামিনে মুক্তির আদেশ দিয়ে থাকেন। এরপর মামলাটির পরবর্তী ধাপ থাকে সংশ্লিষ্ট ধারায় অভিযোগ গঠন বিষয়ে। চার্জ গঠন বিষয়ে শুনানীর সময় আসামী পক্ষে বিজ্ঞ আইনজীবী বিচারকের নিকট অব্যহতি চেয়ে আবেদন পেশ করেন। যুক্তি হিসেবে তুলে ধরেন তালাকের পরে যদি মামলা দায়ের করা হয় তবে সেই ক্ষেত্রে মামলাটি অচল হবে এবং আসামী অব্যাহতি বা খালাস পাবেন। এ বিষয়ে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একটি সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করেন যে, একটি মামলার ঘটনার তারিখ দেখানো হয়েছে ৫/০৯/২০০৯ এবং মামলাটি বিজ্ঞ ট্রাইব্যুনালে ফাইল করা হয়েছে ১১/০৯/২০২১ ইং তারিখে। এদিকে স্বামী তার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছেন ১৯/০১/২০০৯ ইং তারিখে। মহামান্য হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণে বলছেন, বিবাহ বিচ্ছেদ আগে হয়েছে। কাজেই কজ অব এ্যাকশনের দিনে ভিকটিমকে তার স্বামীর বাড়িতে থাকার কথা নয়। কিন্তু মাননীয় ট্রাইবুন্যাল আসামী পক্ষে ফৌজদারী কার্যবিধির ২৬৫(সি) ধারামতে অব্যহতির আদেশ চেয়ে করা আবেদনটি খারিজ করে আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। আসামী পক্ষ উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্টে রিভিশন দাখিল করেন। মহামান্য হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণে উক্ত অভিযোগ গঠন বাতিল করে আসামীকে অব্যহতি দেন। এরপর বাদী (রাষ্ট্র) পক্ষ মহামান্য হাইকোর্টের উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যান। মাননীয় আপিল বিভাগ সাাক্ষ্য ও তথ্য উপাত্ত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত দেয় যে, অভিযুক্ত স্বামীকে খালাস দেওয়ার হাইকোর্টের আদেশ সঠিক। (রওশন আরা বেগম বনাম মোঃ মিজানুর রহমান ও অন্যান্য, হাইকোর্ট বিভাগ, ১২ এডিসি, পৃষ্ঠা-৯৬ এবং রাষ্ট্র বনাম মোঃ রফিজুল হক, ৬ এএলআর (এডি), ভলিউম-২, পৃষ্ঠা-৯০)।

এবার দেখি যৌতুকের সংজ্ঞার মহামান্য হাইকোর্ট কি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বিয়ের পর স্বামী কিংবা স্ত্রীপক্ষ অন্য পক্ষের কাছে অর্থ-সম্পদ দাবি করলেই তা যৌতুক বলে বিবেচিত হবে না। এ ধরনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে যৌতুক নিরোধ আইনে মামলা করলে সে মামলাও চলবে না। কাজেই হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী, বিয়ের সময় কোনো পক্ষ শর্ত দিয়ে থাকলে এবং পরে সে অনুযায়ী অর্থ-সম্পদ দাবি করলে তা যৌতুক হিসেবে গণ্য হবে এবং তখন যৌতুক নিরোধ আইনে মামলা করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে। যৌতুক নিরোধ আইনে করা একটি মামলা বাতিল চেয়ে আসামির করা আবেদনের শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ৯ এপ্রিল বিচারপতি মো. মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি আবদুর রবের হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই রায় দেন। আদালত একই সঙ্গে মামলাটির কার্যক্রম বাতিল ঘোষণা করেন। ওই মামলার আসামির নাম এন এম শফিকুর রহমান। ২০০৪ সালের ১৮ ফেব্রয়ারি সালমা সুলতানা নামের এক নারীর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। সালমা ২০০৯ সালের ১৬ নভেম্বর স্বামীর বিরুদ্ধে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে যৌতুক নিরোধ আইনের ৪ ধারায় মামলা করেন। মামলায় বাদী পক্ষে উল্লেখ করেন, বিয়ের কিছুদিন পরই সালমা বুঝতে পারেন তাঁর স্বামী মানসিকভাবে অসুস্থ ও হতাশাগ্রস্ত। তিনি (সালমা) শ্বশুর-শাশুড়িকে বিষয়টি জানান এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে বলেন। কিন্তু শফিকুর জানান, তিনি অসুস্থ কিংবা হতাশাগ্রস্ত নন। সালমা মনে করেন, তাঁর স্বামী পরধন লোভী। সে জন্যই ব্যবসার কথা বলে তাঁর (সালমা) কাছে পাঁচ লাখ টাকা চান। বাবার বাড়ি থেকে ওই টাকা এনে দিতে অস্বীকার করায় তাঁকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। এক পর্যায়ে সালমা বাবার বাড়ি চলে যান। কিছুদিন পর তাঁকে ফিরিয়ে আনেন শফিকুর। কিন্তু তাঁর (শফিকুর) স্বভাব পরিবর্তন হয় না। ২০০৯ সালের ২০ মে আবার পাঁচ লাখ টাকা এনে দিতে চাপ দেন। এবার শফিকুর বলেন, তিনি ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট কিনতে চান। সালমা ফের টাকা এনে দিতে অস্বীকার করেন। এতে তাঁকে নির্যাতন করা হয়। সালমা স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করে বাবার বাড়ি যেতে বাধ্য হন। সর্বশেষ ২০০৯ সালের ১৪ নভেম্বর সালমার বাবার বাড়ি গিয়ে একই পরিমাণ টাকা দাবি করেন শফিকুর। টাকা না দিলে স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি দেন। পরে বাধ্য হয়ে সালমা তাঁর (শফিকুর) বিরুদ্ধে মামলা করেন।

নি¤œ আদালত শফিকুরের বিরুদ্ধে মামলটি আমলে নেন। পরে মামলা বিচারের জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট-১৮তে স্থানান্তর করলে বিচারক আসামি শফিকুরের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। শফিকুর তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা বেআইনি হয়েছে উল্লেখ করে মামলা কার্যক্রম বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে ফৌজদারি বিবিধ মামলা করেন। প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্ট কেন মামলার কার্যক্রম বাতিল ঘোষণা করা হবে না, সে মর্মে রুল জারি করেন। সেই রুলের শুনানি শেষে আদালত রায় দেন। আদালত রায়ে বলেছেন, আইনে স্পষ্ট রয়েছে, বিয়ের সময়কার শর্ত হিসেবে বিয়ের মজলিসে কিংবা বিয়ের আগে অথবা পরে কোনো সময় অর্থ-সম্পদ দাবি করা হলে তবে তা যৌতুক হিসেব গণ্য হবে। (এন.এম. শফিকুর রহমান বনাম রাষ্ট্র, ৭ এএলআর, পৃষ্ঠা ৩১৩)।

কাজেই সাজানো যৌতুকের মামলার ক্ষেত্রে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেওয়ার সময় হাইকোর্টের রায় মেনে চললে মামলা কমবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’।Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮

এই সংবাদ টি সবার সাথে শেয়ার করুন




দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।  © All rights reserved © 2018 dainikinternational.com
Design & Developed BY Anamul Rasel